ঢাকা ০৬:৫৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ব্যবহৃত স্বর্ণের কী যাকাত দিতে হবে?

প্রশ্ন: আমার প্রায় ১০ ভরি স্বর্ণ আছে। ২/৩ ভরি সাধারণত ব্যবহার করি। বাকি স্বর্ণ কেবল বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহার করি। এক বোন বললেন, ‘যে স্বর্ণ নিয়মিত ব্যবহার করা হয় তার জাকাত দিতে হয় না।’ এব্যাপারে আমাদের সমাজে বহু বিভ্রান্তি ছাড়ানো হয়।

আমার জানার বিষয় হল, ওই বোনের কথাটি কি ঠিক? এ বিষয়ে ইসলামী শরীয়াহর বিধান বিস্তারিত দলীলসহ জানালে বাধিত হব।

উত্তর: আপনার বোনের কথা ঠিক নয়। একাধিক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার জাকাত দিতে হয়।

নিম্নে কিছু বর্ণনা উল্লেখ করা হল: সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, এক নারী তার মেয়েকে নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসেন। মেয়েটির হাতে দুটি স্বর্ণের চুড়ি ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি এ অলংকারের জাকাত আদায় কর? নারী বললেন, না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তুমি কি পছন্দ কর যে, এ দুটি চুড়ির বদলে তোমাকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন আগুনের দুটো চুড়ি পরাবেন? (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৬৩, হাদিসটিকে ইবনুল কাত্তান, মুনযিরি, যাইলায়ী প্রমুখ হাদিস বিশারদগণ সহিহ বলেছেন। নাসবুর রায়াহ ২/৩৭০; বায়ানুল ওয়াহামি ওয়াল ঈহাম ৫/৩৬৬)

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম আমার কাছে আসলেন, তখন আমার হাতে রূপার দুটো চুড়ি ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা কী আয়েশা? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি যেন আপনার সামনে সেজেগুজে থাকতে পারি এজন্য এগুলো বানিয়েছি। তিনি বললেন, তুমি কি এগুলোর জাকাত আদায় কর? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, এগুলোই তোমাকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।

(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৬৫; হাকেম, ইবনু দাকীকিল ঈদ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস ১৪৭৭; নাসবুর রায়াহ ২/৩৭১)

উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি স্বর্ণের এক প্রকার অলংকার ব্যবহার করতাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, এটা কি কানযের অন্তর্ভুক্ত? (কুরআনুল কারীমে যার জন্য শাস্তির কথা এসেছে) তিনি বললেন- জাকাতের নেসাব পরিমাণ হলে যদি তার জাকাত আদায় করা হয় তাহলে তা কানযের অন্তর্ভুক্ত থাকে না।

(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৬৪; ইমাম হাকেম হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। ইমাম নববী বলেন, হাদিসটি হাসান। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস ১৪৭৮; আল মাজমু ৫/৫১৭)

এজাতীয় বর্ণনাকে সামনে রেখে বড় বড় ফকিহ সাহাবি ও তাবেয়িরা স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার জাকাত দেওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন।

মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে বর্ণিত আছে, উমর রা. আবু মূসা আশআরী রা.-এর নামে এ মর্মে চিঠি লেখেন যে- আপনি আপনার আশপাশের মুসলিম নারীদেরকে তাদের অলংকারের জাকাত আদায় করার আদেশ দিন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাদিস ১০২৫৭, ইমাম বুখারী বর্ণনাটিকে মুরসাল বলেছেন। -আত-তারীখুল কাবীর ৪/২১৭)

আরেক হাদিসে এসেছে, এক নারী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে নিজ অলংকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বললেন, এগুলোর কি জাকাত দিতে হবে? তিনি বলেন- যদি দুইশত দিরহাম (অর্থাৎ জাকাতের নেসাব) পরিমাণ হয় তাহলে এর জাকাত আদায় কর।

(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৭০৫৫, আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদিস ৯৫৯৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস ৪৩৫৮)

এছাড়াও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা., আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. প্রমুখ সাহাবী এবং ইবনে সীরীন, ইবনুল মুসায়্যিব, সাঈদ ইবনে জুবাইর, আতা, মুজাহিদ, যুহরী, আলকামা, আসওয়াদ ও উমর ইবনে আবদুল আযীয প্রমুখ তাবেয়ী অনুরূপ ফতোয়া দিতেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস ৭০৫৪, ৭০৫৯, ৭০৬০, ৭০৬৫, ৭০৫৭)

একারণেই প্রখ্যাত তাবেয়ী আতা, যুহরী ও মাকহুল বলেন- স্বর্ণ ও রূপার অলংকারে জাকাত দিতে হয়। এটি পূর্ব থেকে চলে আসা সুন্নত। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস ১০২৬৭)

মোটকথা, উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার জাকাত দিতে হয়।

ব্যবহৃত অলংকারের জাকাত দিতে হয় না- এ মর্মে সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতটি সনদের দিক থেকে সহিহ নয়। দেখুন, আলখিলাফিয়্যাত, বাইহাকী ৪/৩৭৪; তানকীহুত তাহকীক, ইবনু আব্দিল হাদী ২/২১০; নাসবুর রায়াহ ২/৩৭৪

এক্ষেত্রে যারা বলেন, অলংকারের জাকাত দিতে হবে না, তারা দলীল হিসাবে কিছু আছার উল্লেখ করেন। তবে অলংকারের জাকাত ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি যেহেতু বিভিন্ন হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, তাই এ মতটিই দলীলের বিচারে অধিক শক্তিশালী।

কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/২৮৩; শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ২/৩১৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/১০১; ফাতহুল কাদীর ২/১৬২; আলবাহরুর রায়েক ২/২২৬

কেকে

ট্যাগস :

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

জনপ্রিয় সংবাদ

ব্যবহৃত স্বর্ণের কী যাকাত দিতে হবে?

আপডেট সময় : ০৮:৩২:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

প্রশ্ন: আমার প্রায় ১০ ভরি স্বর্ণ আছে। ২/৩ ভরি সাধারণত ব্যবহার করি। বাকি স্বর্ণ কেবল বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহার করি। এক বোন বললেন, ‘যে স্বর্ণ নিয়মিত ব্যবহার করা হয় তার জাকাত দিতে হয় না।’ এব্যাপারে আমাদের সমাজে বহু বিভ্রান্তি ছাড়ানো হয়।

আমার জানার বিষয় হল, ওই বোনের কথাটি কি ঠিক? এ বিষয়ে ইসলামী শরীয়াহর বিধান বিস্তারিত দলীলসহ জানালে বাধিত হব।

উত্তর: আপনার বোনের কথা ঠিক নয়। একাধিক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার জাকাত দিতে হয়।

নিম্নে কিছু বর্ণনা উল্লেখ করা হল: সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, এক নারী তার মেয়েকে নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসেন। মেয়েটির হাতে দুটি স্বর্ণের চুড়ি ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি এ অলংকারের জাকাত আদায় কর? নারী বললেন, না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তুমি কি পছন্দ কর যে, এ দুটি চুড়ির বদলে তোমাকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন আগুনের দুটো চুড়ি পরাবেন? (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৬৩, হাদিসটিকে ইবনুল কাত্তান, মুনযিরি, যাইলায়ী প্রমুখ হাদিস বিশারদগণ সহিহ বলেছেন। নাসবুর রায়াহ ২/৩৭০; বায়ানুল ওয়াহামি ওয়াল ঈহাম ৫/৩৬৬)

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম আমার কাছে আসলেন, তখন আমার হাতে রূপার দুটো চুড়ি ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা কী আয়েশা? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি যেন আপনার সামনে সেজেগুজে থাকতে পারি এজন্য এগুলো বানিয়েছি। তিনি বললেন, তুমি কি এগুলোর জাকাত আদায় কর? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, এগুলোই তোমাকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।

(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৬৫; হাকেম, ইবনু দাকীকিল ঈদ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস ১৪৭৭; নাসবুর রায়াহ ২/৩৭১)

উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি স্বর্ণের এক প্রকার অলংকার ব্যবহার করতাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, এটা কি কানযের অন্তর্ভুক্ত? (কুরআনুল কারীমে যার জন্য শাস্তির কথা এসেছে) তিনি বললেন- জাকাতের নেসাব পরিমাণ হলে যদি তার জাকাত আদায় করা হয় তাহলে তা কানযের অন্তর্ভুক্ত থাকে না।

(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৫৬৪; ইমাম হাকেম হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। ইমাম নববী বলেন, হাদিসটি হাসান। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস ১৪৭৮; আল মাজমু ৫/৫১৭)

এজাতীয় বর্ণনাকে সামনে রেখে বড় বড় ফকিহ সাহাবি ও তাবেয়িরা স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার জাকাত দেওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন।

মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে বর্ণিত আছে, উমর রা. আবু মূসা আশআরী রা.-এর নামে এ মর্মে চিঠি লেখেন যে- আপনি আপনার আশপাশের মুসলিম নারীদেরকে তাদের অলংকারের জাকাত আদায় করার আদেশ দিন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাদিস ১০২৫৭, ইমাম বুখারী বর্ণনাটিকে মুরসাল বলেছেন। -আত-তারীখুল কাবীর ৪/২১৭)

আরেক হাদিসে এসেছে, এক নারী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে নিজ অলংকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বললেন, এগুলোর কি জাকাত দিতে হবে? তিনি বলেন- যদি দুইশত দিরহাম (অর্থাৎ জাকাতের নেসাব) পরিমাণ হয় তাহলে এর জাকাত আদায় কর।

(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৭০৫৫, আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদিস ৯৫৯৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস ৪৩৫৮)

এছাড়াও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা., আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. প্রমুখ সাহাবী এবং ইবনে সীরীন, ইবনুল মুসায়্যিব, সাঈদ ইবনে জুবাইর, আতা, মুজাহিদ, যুহরী, আলকামা, আসওয়াদ ও উমর ইবনে আবদুল আযীয প্রমুখ তাবেয়ী অনুরূপ ফতোয়া দিতেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস ৭০৫৪, ৭০৫৯, ৭০৬০, ৭০৬৫, ৭০৫৭)

একারণেই প্রখ্যাত তাবেয়ী আতা, যুহরী ও মাকহুল বলেন- স্বর্ণ ও রূপার অলংকারে জাকাত দিতে হয়। এটি পূর্ব থেকে চলে আসা সুন্নত। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস ১০২৬৭)

মোটকথা, উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার জাকাত দিতে হয়।

ব্যবহৃত অলংকারের জাকাত দিতে হয় না- এ মর্মে সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতটি সনদের দিক থেকে সহিহ নয়। দেখুন, আলখিলাফিয়্যাত, বাইহাকী ৪/৩৭৪; তানকীহুত তাহকীক, ইবনু আব্দিল হাদী ২/২১০; নাসবুর রায়াহ ২/৩৭৪

এক্ষেত্রে যারা বলেন, অলংকারের জাকাত দিতে হবে না, তারা দলীল হিসাবে কিছু আছার উল্লেখ করেন। তবে অলংকারের জাকাত ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি যেহেতু বিভিন্ন হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, তাই এ মতটিই দলীলের বিচারে অধিক শক্তিশালী।

কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/২৮৩; শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ২/৩১৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/১০১; ফাতহুল কাদীর ২/১৬২; আলবাহরুর রায়েক ২/২২৬

কেকে