ওমর ফারুক,খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা প্রতিনিধিঃ
চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস (পার্বত্য চট্টগ্রাম) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি ভৌগোলিক ও জাতিগতভাবে সংবেদনশীল এলাকা। ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলকে ‘বিচ্ছিন্ন’ এলাকা ঘোষণা করে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার নাম Chittagong Hill Tracts Regulation 1900, যা অধিক পরিচিত হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল ১৯০০ নামে। যদিও এই আইন মূলত ঐসময়ে শুধুমাত্র পাহাড়ি জনজাতিগোষ্ঠীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবেচনায় প্রবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান সময়ে অপ্রচলিত ও গণতন্ত্রবিরোধী এই আইন পুনরায় প্রয়োগের ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ একশ্রেণীর উপজাতীয় গোষ্ঠীরা। বাস্তবিক অর্থে, বর্তমানে আধুনিক যুগে কোনো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা বিট্রিশদের তৈরি অপ্রচলিত আইন জীবনযাপনে অদৃশ্যমান। প্রায় দু-দশক পূর্বে হাই কোর্ট অপ্রচলিত ‘হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল ১৯০০’ নামের আইনটিকে মৃত ঘোষনার পর আবারও চালুর ষড়যন্ত্র বা সম্ভাব্য বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদে পার্বত্য অঞ্চলে সচেতন সাধারণের জন্য এক চরম বৈষম্যমূলক ও দমনমূলক ব্যবস্থায় পরিণত হবে।
১. আইনের মূল বৈশিষ্ট্য ও কাঠামো
হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল ১৯০০ মূলত নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত:
পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘Excluded Area’ ঘোষণা করে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামো গঠন।
উপজাতীয়দের জন্য আলাদা রাজা/চিফ ও সার্কেল চিফদের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা।
ভূমি দখলে, বসবাস ও বিচারব্যবস্থায় জাতিগত বিভাজন। (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরার আধিপত্য বিস্তার)
সমতল/ পার্বত্য বাঙ্গালিদের প্রবেশ ও ভূমি অধিগ্রহণে নিয়ন্ত্রণ (Permit System)।
এই কাঠামোটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক রক্ষা নিশ্চিত করলেও, বাঙালি জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকারকে বঞ্চিত করে দেয়।
২. ভূমি মালিকানায় বৈষম্য
পার্বত্য এলাকায় জমি কেনাবেচার উপর বাঙালিদের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল অনুসারে:
শুধুমাত্র উপজাতীয়রাই ভূমির মালিক হতে পারেন।
বাঙালিরা সেখানে জমি কিনতে বা বসতি গড়তে পারে না, এমনকি সরকারি খাসজমিতেও পুনর্বাসনের অধিকার সীমিত।
ফলাফল: রাষ্টীয় সিদ্ধান্তে ১৯৭৯ সালের পুনর্বাসন প্রকল্পে স্থানান্তরিত বাঙালি পরিবারগুলোর একাংশ আজও জমির কাগজ বা মালিকানা পায়নি। ভূমি বিরোধে প্রায়শই বাঙ্গালীরা সহিংসতার শিকার।
৩. বিচারিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য
পাহাড়ি সমাজের জন্য আলাদা customary law ও চিফদের অধীনে বিচারব্যবস্থা কার্যকর।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদে পাহাড়িদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ।
ফলাফল: সরকারি সকল প্রকার কর দেওয়া সত্ত্বেও বাঙালিরা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাজেট বণ্টন বা বিচার প্রাপ্তিতে অন্তর্ভুক্ত নয়। এটি সাংবিধানিক সমতার লঙ্ঘন।
৪. নিরাপত্তা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
১৯৮০ ও ৯০ দশকে থেকে এখনও শান্তিবাহিনী, ইউপিডিএফ, কুকি চিন উপজাতীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাঙালিদের “অবৈধ বসতি স্থাপনকারী” আখ্যা দিয়ে সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে।
নিশিরাতে ঘুমন্ত গ্রামবাসীদের জ্বালিয়ে দেওয়া, নারী নির্যাতন, হত্যা, গুম,চাঁদাবাজি, উচ্ছেদ ও বাস্তুচ্যুতি ঘঠিয়েছিল ।
আজও বহু বাঙালি পরিবার “অন্তর্বর্তীকালীন বাস্তুচ্যুত” (IDPs) হিসেবে বসবাস করছে।
প্রশ্ন: দেশের নাগরিক হয়েও বাঙালিরা নিজেদের ভূমিতে কেন নিরাপদ নয়?
৫. সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিকতা
বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে:
“প্রত্যেক নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার থাকবে।” — (১৪ অনুচ্ছেদ)
কিন্তু হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল ও এর অনুসন্ধানসূত্র আইনগুলো:
বাঙালিদের জমি অধিকার, বসবাস, বিচার, চাকরি ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশগ্রহণ থেকে প্রায়ই বঞ্চিত করেছে।
উপজাতিদের জন্য যে সুবিধা রক্ষার কথা বলা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঙালী নিধন ও বঞ্চনা।
৬. পার্বত্য চুক্তি ও কিছু ম্যানুয়াল ধারা বহাল প্রসঙ্গে:
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তিতে স্বাক্ষরের পর কিছু আইনি রেখেছিল। এখন একশ্রেণীর এলিট গোষ্ঠী হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল ১৯০০ সম্পূর্ণ বহাল রাখতে চাচ্ছে যা সম্পূর্ণ দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র।
বিতর্কিত ভূমি কমিশন গঠন হলেও কার্যকর ভূমি বিতরণ হয়নি। পার্বত্য চুক্তির পরও পাহাড়ে সাধারণ পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালিরা নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এলিট গোষ্ঠী উপজাতির জন্য।
হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল ১৯০০ একটি ঔপনিবেশিক আইনের নিদর্শন, যা আধুনিক রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার ও নাগরিক সমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে। এটি যেমন পাহাড়িদের মধ্যে এক এলিট শ্রেণীর একচেটিয়া জাতিসত্তার ধারণা তৈরি করেছে, তেমনি বাঙালিদের বিচ্ছিন্ন ও অবদমিত করে তুলেছে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা এখন প্রায় সবাই শিক্ষিত, তাদের মধ্যে অনেকেই বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে অমিল এমন অপ্রচলিত আইন চান না। যদি এই বিতর্কিত আইন বহাল থাকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ও ন্যায়ভিত্তিক সহাবস্থান সম্প্রীতি সম্ভব নয়।
সম্ভাব্য প্রস্তাবনা :
১. হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল ১৯০০ বাতিল অথবা সংবিধান অনুযায়ী পুনর্গঠন করতে হবে।
২. বাঙালিদের ভূমি মালিকানা, প্রশাসনিক পদে অন্তর্ভুক্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. সকল জাতিগোষ্ঠীর জন্য সমান আইনি কাঠামো গঠন করে নাগরিকত্বের ভিত্তিতে অধিকার নির্ধারণ করতে হবে।
৪. পাহাড়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য বহুপাক্ষিক আলোচনা এবং বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা গ্রহণ আবশ্যক।
এমএস