ঢাকা ০১:৪৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দাসদের মাথার খুলিতে পানীয় পান করতেন অক্সফোর্ডের শিক্ষকরা!

ছবি : সংগৃহীত

আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলগুলো থেকে কালো চামড়ার মানুষকে জোরপূর্বক আমেরিকা ও ইউরোপে বিক্রি করা হতো। দাসপ্রথার ভয়াবহতা সম্পর্কে কমবেশি সবাই শুনেছেন। অনুসন্ধান বা গবেষণায় বিভিন্ন সময় দাসদের অত্যাচার ও নিপীড়নের এসব তথ্য উঠে এসেছে। মৃত্যুর পর তাদের দেহাবশেষও রেহাই পায়নি। লাশের মাথার খুলি দিয়ে তৈরি হয়েছে পান পাত্র!

মানুষের মাথার খুলিতে নকশা ও পলিশ করে তাতে রূপার হাতল লাগিয়ে অত্যন্ত সুন্দর পান পাত্র তৈরি করা হত। সেই পাত্রে কয়েক দশক ধরে পানীয় পান করতেন অক্সফোর্ডের ওরচেস্টার কলেজের শিক্ষকরা। মাত্র দশ বছর আগেও প্রতিনিয়ত এই পাত্র থেকে ওয়াইন পান করতেন। পরে ওয়াইন চুইয়ে পড়া শুরু করলে তাতে চকোলেট খেতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্য। ঔপনিবেশিক যুগে লুট হওয়া মানব দেহাবশেষ নিয়ে এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।

সম্প্রতি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

আফ্রিকান ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত ব্রিটেনের ‘অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের’ সদস্য ও লেবার পার্টির এমপি বেল রিবেরিও অ্যাডি বলেন, ঔপনিবেশিক সহিংসতা ও শোষণের মাধ্যমে গড়া সমৃদ্ধ এই প্রাচীরে দাঁড়িয়ে অক্সফোর্ডের ডনরা মানুষের মাথার খুলি দিয়ে বানানো পাত্রে পানীয় পান করছেন, দৃশ্যটি ভাবলেই কেমন যেন গা গুলিয়ে বমি আসে! হতে পারে খুলিটি একজন দাসের, যাকে এতটাই তুচ্ছ করা হয়েছে যে তার মাথার খুলিকে একটি পাত্রে তৈরি করা হয়েছে!

সম্প্রতি ওরচেস্টার কলেজের পিট রিভারস জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড্যান হিকসের নতুন বই ‘এভরি মনুমেন্ট উইল ফল’ বইয়ে এসব লজ্জাজনক তথ্য উঠে এসেছে।

হিকস জানান, কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী ও অতিথিদের মধ্যে মানুষের খুলি দিয়ে বানানো পাত্রে পানীয় পানে অস্বস্তি বাড়ার কারণে ২০১৯ সালের দিকে এই পাত্রের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় এই পাত্রটি কোথা থেকে আর কী করে কলেজের খাবারের টেবিলে জায়গা পেল; তা জানতে হিকসকে অনুসন্ধান করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

হিকস বলেন, ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তবে সেসব বিতর্ক সাধারণত এই ঔপনিবেশিক শাসন থেকে যারা লাভবান হয়েছে তাদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। যেমন সিসলি রোডস কিংবা এডওয়ার্ড কলস্টন— যাদের নামে অনেক স্ট্যাচু কিংবা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে।

তবে হিকস চেয়েছিলেন এসব লাভবান নয় বরং ঔপনিবেশিক শাসনের যারা শিকার, যাদের নাম ইতিহাস থেকে মুছে গিয়েছে, তাদের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে।

তিনি বলেন, ব্রিটিশ সংস্কৃতি ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ নিয়ে থাকা বর্ণবাদের কারণে এসব মানুষকে একদমই গুরুত্ব দেওয়া হতো না। এ ধরণের অমানবিকতা ও পরিচয় ধ্বংস করাও সহিংসতার অংশ বলে মনে করেন তিনি।

এ পাত্রের খুলির মালিক কে, তার সঠিক তথ্য পাননি হিকস। তবে কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যমতে, খুলিটি আনুমানিক ২২৫ বছর আগের। খুলির আকার ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করে হিকস জেনেছেন, খুলিটি একজন দাস নারীর এবং তাকে ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।

খুলিটি কার সেটির কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ না থাকলেও খুলি দিয়ে তৈরি পাত্রটির মালিকের নাম কিন্তু রূপা দিয়ে খোদাই করা ছিল। ১৯৪৬ সালে কলেজে এই পাত্রটি উপহার দেন সাবেক শিক্ষার্থী জর্জ পিট রিভারস।

যিনি একজন ইউজেনিসিস্ট ছিলেন। একটি বিশেষ জাতিকে সন্তান উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের উন্নতি করার ধারণাকে ইউজেনিকস বলা হয়। এই ধারণার সঙ্গে বর্ণবাদ ও নাৎসি তত্ত্বের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই এই নীতিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন না। নাৎসি শাসক ওসওয়াল্ড মোসলিকে সমর্থন করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার তাকে কারাবন্দিও করেছিল।

যাই হোক, খুলিটি জর্জ পিট পেয়েছিলেন তার দাদা হেনরি লেন ফক্স পিট রিভার্সের থেকে। তিনিই পিট রিভার্স মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ১৮৮৪ সালে একটি নিলামে এই পাত্রটি কিনেছিলেন। সে সময় পাত্রটিতে একটি কাঠের হাতল ছিল। সেটির নিচে রানী ভিক্টোরিয়ার নাম খোদিত ছিল এবং তার অভিষেকের বছরেই অর্থাৎ ১৮৩৮ সালে তৈরি করা হয়েছিল পাত্রটি।

নিলামে পাত্রটি বিক্রি করেছিরেন বার্নাড স্মিথ নামে এক ব্যক্তি। হিকসের ধারণা, এটি তিনি তার বাবার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন। স্মিথের বাবা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ভিক্টোরিয়ান যুগে রয়েল আর্মিতে কর্মরত ছিলেন।

এ বিষয়ে ওরচেস্টার কলেজের এক মুখপাত্র বলেন, বিংশ শতাব্দীর দিকে মাঝে মাঝে এই পাত্রটি প্রদর্শন করা হতো, আবার অনেক সময় ব্যবহারও করা হতো। তবে কতবার ব্যবহার করা হয়েছে তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে ২০১১ সাল থেকে এর ব্যবহার সীমিত করা হয়। আর ২০১৫ সালে পুরোপুরি ব্যবহার করা বন্ধ হয়ে যায়।

গবেষকদের ও আইনি পরামর্শ মেনে কলেজ কর্তৃপক্ষ পাত্রটিকে সম্মানের সঙ্গে সংগ্রহশালায় রাখার ও এর ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান তিনি।

এই খুলিটির বিষয় ছাড়াও ঔপনিবেশিক আমলে লুট হওয়া আরও কিছু খুলির তথ্য হিকসের বইয়ে আছে। এরমধ্যে ফিল্ড মার্শাল লর্ড গ্রেনফিল্ডের একজন জুলু কমান্ডারের খুলি লুটের তথ্য আছে।

কেকে

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

জনপ্রিয় সংবাদ

দাসদের মাথার খুলিতে পানীয় পান করতেন অক্সফোর্ডের শিক্ষকরা!

আপডেট সময় : ১০:০৪:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলগুলো থেকে কালো চামড়ার মানুষকে জোরপূর্বক আমেরিকা ও ইউরোপে বিক্রি করা হতো। দাসপ্রথার ভয়াবহতা সম্পর্কে কমবেশি সবাই শুনেছেন। অনুসন্ধান বা গবেষণায় বিভিন্ন সময় দাসদের অত্যাচার ও নিপীড়নের এসব তথ্য উঠে এসেছে। মৃত্যুর পর তাদের দেহাবশেষও রেহাই পায়নি। লাশের মাথার খুলি দিয়ে তৈরি হয়েছে পান পাত্র!

মানুষের মাথার খুলিতে নকশা ও পলিশ করে তাতে রূপার হাতল লাগিয়ে অত্যন্ত সুন্দর পান পাত্র তৈরি করা হত। সেই পাত্রে কয়েক দশক ধরে পানীয় পান করতেন অক্সফোর্ডের ওরচেস্টার কলেজের শিক্ষকরা। মাত্র দশ বছর আগেও প্রতিনিয়ত এই পাত্র থেকে ওয়াইন পান করতেন। পরে ওয়াইন চুইয়ে পড়া শুরু করলে তাতে চকোলেট খেতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্য। ঔপনিবেশিক যুগে লুট হওয়া মানব দেহাবশেষ নিয়ে এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।

সম্প্রতি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

আফ্রিকান ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত ব্রিটেনের ‘অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের’ সদস্য ও লেবার পার্টির এমপি বেল রিবেরিও অ্যাডি বলেন, ঔপনিবেশিক সহিংসতা ও শোষণের মাধ্যমে গড়া সমৃদ্ধ এই প্রাচীরে দাঁড়িয়ে অক্সফোর্ডের ডনরা মানুষের মাথার খুলি দিয়ে বানানো পাত্রে পানীয় পান করছেন, দৃশ্যটি ভাবলেই কেমন যেন গা গুলিয়ে বমি আসে! হতে পারে খুলিটি একজন দাসের, যাকে এতটাই তুচ্ছ করা হয়েছে যে তার মাথার খুলিকে একটি পাত্রে তৈরি করা হয়েছে!

সম্প্রতি ওরচেস্টার কলেজের পিট রিভারস জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড্যান হিকসের নতুন বই ‘এভরি মনুমেন্ট উইল ফল’ বইয়ে এসব লজ্জাজনক তথ্য উঠে এসেছে।

হিকস জানান, কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী ও অতিথিদের মধ্যে মানুষের খুলি দিয়ে বানানো পাত্রে পানীয় পানে অস্বস্তি বাড়ার কারণে ২০১৯ সালের দিকে এই পাত্রের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় এই পাত্রটি কোথা থেকে আর কী করে কলেজের খাবারের টেবিলে জায়গা পেল; তা জানতে হিকসকে অনুসন্ধান করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

হিকস বলেন, ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তবে সেসব বিতর্ক সাধারণত এই ঔপনিবেশিক শাসন থেকে যারা লাভবান হয়েছে তাদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। যেমন সিসলি রোডস কিংবা এডওয়ার্ড কলস্টন— যাদের নামে অনেক স্ট্যাচু কিংবা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে।

তবে হিকস চেয়েছিলেন এসব লাভবান নয় বরং ঔপনিবেশিক শাসনের যারা শিকার, যাদের নাম ইতিহাস থেকে মুছে গিয়েছে, তাদের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে।

তিনি বলেন, ব্রিটিশ সংস্কৃতি ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ নিয়ে থাকা বর্ণবাদের কারণে এসব মানুষকে একদমই গুরুত্ব দেওয়া হতো না। এ ধরণের অমানবিকতা ও পরিচয় ধ্বংস করাও সহিংসতার অংশ বলে মনে করেন তিনি।

এ পাত্রের খুলির মালিক কে, তার সঠিক তথ্য পাননি হিকস। তবে কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যমতে, খুলিটি আনুমানিক ২২৫ বছর আগের। খুলির আকার ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করে হিকস জেনেছেন, খুলিটি একজন দাস নারীর এবং তাকে ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।

খুলিটি কার সেটির কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ না থাকলেও খুলি দিয়ে তৈরি পাত্রটির মালিকের নাম কিন্তু রূপা দিয়ে খোদাই করা ছিল। ১৯৪৬ সালে কলেজে এই পাত্রটি উপহার দেন সাবেক শিক্ষার্থী জর্জ পিট রিভারস।

যিনি একজন ইউজেনিসিস্ট ছিলেন। একটি বিশেষ জাতিকে সন্তান উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের উন্নতি করার ধারণাকে ইউজেনিকস বলা হয়। এই ধারণার সঙ্গে বর্ণবাদ ও নাৎসি তত্ত্বের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই এই নীতিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন না। নাৎসি শাসক ওসওয়াল্ড মোসলিকে সমর্থন করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার তাকে কারাবন্দিও করেছিল।

যাই হোক, খুলিটি জর্জ পিট পেয়েছিলেন তার দাদা হেনরি লেন ফক্স পিট রিভার্সের থেকে। তিনিই পিট রিভার্স মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ১৮৮৪ সালে একটি নিলামে এই পাত্রটি কিনেছিলেন। সে সময় পাত্রটিতে একটি কাঠের হাতল ছিল। সেটির নিচে রানী ভিক্টোরিয়ার নাম খোদিত ছিল এবং তার অভিষেকের বছরেই অর্থাৎ ১৮৩৮ সালে তৈরি করা হয়েছিল পাত্রটি।

নিলামে পাত্রটি বিক্রি করেছিরেন বার্নাড স্মিথ নামে এক ব্যক্তি। হিকসের ধারণা, এটি তিনি তার বাবার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন। স্মিথের বাবা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ভিক্টোরিয়ান যুগে রয়েল আর্মিতে কর্মরত ছিলেন।

এ বিষয়ে ওরচেস্টার কলেজের এক মুখপাত্র বলেন, বিংশ শতাব্দীর দিকে মাঝে মাঝে এই পাত্রটি প্রদর্শন করা হতো, আবার অনেক সময় ব্যবহারও করা হতো। তবে কতবার ব্যবহার করা হয়েছে তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে ২০১১ সাল থেকে এর ব্যবহার সীমিত করা হয়। আর ২০১৫ সালে পুরোপুরি ব্যবহার করা বন্ধ হয়ে যায়।

গবেষকদের ও আইনি পরামর্শ মেনে কলেজ কর্তৃপক্ষ পাত্রটিকে সম্মানের সঙ্গে সংগ্রহশালায় রাখার ও এর ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান তিনি।

এই খুলিটির বিষয় ছাড়াও ঔপনিবেশিক আমলে লুট হওয়া আরও কিছু খুলির তথ্য হিকসের বইয়ে আছে। এরমধ্যে ফিল্ড মার্শাল লর্ড গ্রেনফিল্ডের একজন জুলু কমান্ডারের খুলি লুটের তথ্য আছে।

কেকে