প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি গঠনের অনুমোদন চিঠি চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সাবেক মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর করা রিটের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়ের করা সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল মামলার শুনানিতে এ স্থগিতাদেশ প্রদান করেন বিচারপতি মো. রেজাউল হক। গত মঙ্গলবার এ শুনানি হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, স্থগিতাদেশের ফলে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চসিকের অধীনে পরিচালনায় আর কোনো বাধা নেই। অর্থাৎ চসিকের হাতেই ফিরছে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তাকে সহায়তা করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম মোছাদ্দেক বিল্লাহ। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও তার পরিবারের পক্ষে মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ব্যারিস্টার নওশাদ জমীর। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট নকিব সাইফুল্লাহ। জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই বিশ্বদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাটতি পূরণে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে দাপ্তরিক পত্র দেয়। এতে উপাচার্য, উপ–উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য প্যানেল প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে কমিশনকে অবহিত করতে বলা হয়। এর প্রেক্ষিতে চসিক একই বছরের ১১ নভেম্বর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি দলিল সম্পাদন করে কমিশন বরাবর প্রেরণ করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক ইস্যুকৃত পত্রটি চ্যালেঞ্জ করে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী হাই কোর্ট বিভাগে রিট মামলা (১২৮৯২/২০১৫) দায়ের করেন। মহিউদ্দিন চসিক মেয়র বরাবর দেওয়া পত্রকে অবৈধ ও আইন বহির্ভূত দাবি করেন তার রিটে। মামলা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন চসিককে দেওয়া পত্রটি বাতিল করে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম মোছাদ্দেক বিল্লাহ বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে তৎকালীন মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তার পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা করে আসছেন। ইতোমধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল নানারকম দুর্নীতি ও মাদক কারবারিতে ব্যবহৃত হয়েছে বলে পত্রপত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে প্রদত্ত তাদের (মহিউদ্দিন চৌধুরী) পক্ষে কথিত রায়ের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে সুপ্রিম কোর্টে কোনো আপিল দায়ের করেনি।
তিনি বলেন, প্রফেসর এএসএম ফায়েজ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ও ডা. শাহাদাত হোসেন সিটি মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশন মামলায় ২০১৭ সালের প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল মামলা দায়ের করেন। মহামান্য চেম্বার আদালত উক্ত রায়ের কার্যকারিতায় স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। এ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক পরিচালিত হবে।
এদিকে ১০ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন ‘মাফিয়াচক্র’ বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করেছে দাবি করে বলেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন এটা ফিরে পাবে। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ফিরে পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয় চসিক। এতে চসিকের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমতি চাওয়া হয়। চসিকের পত্রে বলা হয়, ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাটতি পূরণে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে দাপ্তরিক পত্র দেয়। তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী চসিক মেয়র বরাবর দেওয়া পত্রকে অবৈধ ও আইন বহির্ভূত দাবি করে হাই কোর্টে রিট মামলা দাখিল করেন। ওই রিট মামলায় মহিউদ্দিন চৌধুরী তাকে উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করে ট্রাস্ট দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রিকরণের ক্ষমতা প্রদান, ট্রাস্টি দলিলে তাকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ঘোষণা এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। শুনানি শেষে আদালত ২০১৬ সালের ১২ জুন এ মামলার রায় দেন। এতে মামলা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ২০১৫ সালে চসিকে যে পত্র দেয় তা বাতিল করে। ফলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ওই পত্রের অবৈধ ঘোষণার যে আবেদন করে তা অকার্যকর হয়ে যায় এবং আদালতও তা খারিজ করে রায় প্রদান করেন।
এদিকে হাই কোর্ট ডিভিশন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গণ্য করে ট্রাস্টি দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রিকরণের ক্ষমতা প্রদান, ট্রাস্টি দলিলে তাকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ঘোষণা এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে অংশগ্রহণের অনুমতি চেয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর আবেদনটি জুডিশিয়াল রিভিউর এখতিয়ারে পড়ে না বলে তাকে পরামর্শ দেয়। এছাড়া বিষয়টি সুরাহার জন্য দেওয়ানী আদালত যথাযথ ফোরাম বলে মতামত দেয়। একইসঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরীর আবেদনটিও খারিজ করে রায় প্রদান করে।
এছাড়া হাই কোর্ট বিভাগ চসিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারে না বলে একটি অবজারভেশন প্রদান করে। অবশ্য চসিক সেটা প্রত্যাহারের জন্য একই আদালতে রিভিউ পিটিশন দায়ের করে। রিভিউ পিটিশনটি মঞ্জুর করে আদালত ২০১৭ সালের ৬ মে রায় দেয়। এতে ‘চসিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারে না’ বলে দেওয়া প্রদত্ত বক্তব্যটি আদালতের মন্তব্য উল্লেখ করে এটি কোনো পক্ষের ওপর বাধ্যকর নয় বলে ঘোষণা করে।
পরে মহিউদ্দিন চৌধুরী ২০১৭ সালের ৬ মে হাই কোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল মোকদ্দমা দায়ের করেন। অবশ্য ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শুনানিতে বাদী পক্ষে কেউ উপস্থিত না থাকায় আপিল বিভাগ লিভ টু আপিল খারিজ করে দেয়।
জানা গেছে, ২০০০ সালে প্রবর্তক মোড়ের হিজরা খালের নালার পাশে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভবনটি নির্মিত হয়। শুরুতে একটি ভবন নির্মাণ করে নিচতলায় দোকান ভাড়া দেওয়া হয়। পরে কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ইনস্টিটিউট অব বিজনেস টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০২ সালে এটিকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলাকালে প্রথম ভবনটি ভাঙা হয়। বর্তমানে জিইসি, ওয়াসা ও হাজারী গলিতে নিজস্ব ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
মহিউদ্দিন চৌধুরী ২০০১ সালের মে মাসে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বরাবরে একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব প্রেরণ করেন। প্রস্তাবটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অধীনে অনুমোদিত হলে ইউজিসি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠদান অনুমোদন করে। ২০০১ সালের ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করা হয়। ২০০২ জানুয়ারি থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। একসময় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে চসিকের লোগো ছিল। চসিকের বিভিন্ন নথিপত্রেও এটি চসিকের মালিকানাধীন বলে দাবি করা হয়।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। পদাধিকার বলে চসিক মেয়র ছিলেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। তবে ‘২০১৯ সালে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করে নেন’ দাবি করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চসিকের পত্রে।
উল্লেখ্য, ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন, উপ–উপাচার্য কাজী শামীম সুলতানা এবং কোষাধ্যক্ষ তৌফিক সাঈদ পদত্যাগ করেন।
সিরাজুল মনির/এমএস